
পানি মানুষের জীবন, স্বাস্থ্য ও স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রাণশক্তি এবং দেশের উন্নয়নের মৌলিক উপাদান। যে পানিসম্পদ মানুষের জীবিকা দান করে, আমাদের বাঁচিয়ে রাখে সেই পানিসম্পদ ও স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশ এখন দূষণ, অপচয়, অতিরিক্ত ও অপরিকল্পিত ব্যবহার, ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন, জলবায়ু পরিবর্তনসহ মানবসৃষ্ট আরও বহু কারণে হুমকির সম্মুখীন। এর বিরূপ প্রভাবে বিশ্বব্যাপী পানীয়-জলের সংকটসহ মানুষ প্রতিনিয়ত বন্যা, খরাসহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে। আমরা জানি, পৃথিবীর মোট ভূ-ভাগের দুই তৃতীয়াংশই পানি। এ থেকেই সাধারণভাবে আমাদের ধারণা, পৃথিবীর পানির ভাণ্ডারটি অফুরন্ত। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর মোট পানির বেশিরভাগ অর্থাৎ ৯৭ শতাংশই সমুদ্রের লোনা পানি। আর ৩ ভাগের মধ্যে ২.৩১ শতাংশ হচ্ছে মেরু অঞ্চলের জমাটবাধা বরফ। অবশিষ্ট ০.৬৯ শতাংশ ব্যবহারযোগ্য পানির মধ্যে আবার ৯৬ শতাংশই রয়েছে ভূগর্ভে। এই হচ্ছে আমাদের অফুরন্ত পানির ভাণ্ডারের হিসাব।
উল্লেখযোগ্য যে, সমুদ্রের পানিসহ ভূ-পৃষ্ঠের সব ধরনের জলাশয়ের পানিই সূর্যের তাপে বাষ্প হয়ে মেঘ আকারে জমা হচ্ছে আকাশে। আবার যথাসময়ে বৃষ্টি হয়ে তা নেমে আসছে ভূ-পৃষ্ঠে। স্থলভাগে বৃষ্টির পানি হয়ে পড়া সমুদ্রের পানির একাংশ খাল নদী হয়ে পুনরায় ফিরে যাচ্ছে সমুদ্রে। বাকি পানি মাটি চুইয়ে গিয়ে জমা হচ্ছে ভূ-গর্ভের পানির ভাণ্ডারে। ভূগর্ভের পানির ভাণ্ডার পুরোপুরি ভরে ভূগর্ভস্থ অদৃশ্য পানি প্রবাহ চলতে থাকে সমুদ্রের দিকে। দেশ-মহাদেশ পেরিয়ে এক সময় গিয়ে পৌঁছে সমুদ্রে। এভাবেই প্রাকৃতিক যন্ত্রটি কাজ করে চলেছে। ১৭৫০ সালের পর অর্থাৎ শিল্পবিপ্লবের শুরু থেকে একশ্রেণীর মানুষ পানিসম্পদের ভারসাম্য ও পরিবেশ রক্ষার নিয়ামক পানি চক্র নামের এই যন্ত্রটির ওপর বিরামহীন আঘাত হেনে চলেছে। শিল্পায়নের থাবা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমেই টান পড়তে শুরু করেছে আমাদের ব্যবহারযোগ্য পানির ভাণ্ডারে।
অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, নগরায়ন, জনবসতি ইত্যাদি গড়ে তুলতে গিয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে বন, নির্বিচারে ও সমূলে উৎপাটিত করা হচ্ছে বৃক্ষ। পৃথিবী ঢাকা পড়তে শুরু করেছে কংক্রিট আর ইট পাথরের আবরনে। ফলে প্রয়োজনীয় বৃষ্টির পানি এখন আর সেই আবরন ভেদ করে স্বাভাবিক গতিতে ভূগর্ভে প্রবেশ করতে পারছে না। পূর্ণ হচ্ছে না ভূগর্ভের পানির ভাণ্ডারটি। তার ওপর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার দানবীয় তৃষ্ণা মিটাতে নলকূপ, গভীর নলকূপ, কূয়া ইত্যাদি বসিয়ে টেনে তোলা হয় ভূগর্ভের পানি। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে। পানির স্তর নেমে যাওয়ায় পানিশূন্য ভাণ্ডারটির শূন্যতা পূরণের জন্য ক্রমে এগিয়ে আসছে সমুদ্রের লোনাপানি। প্রাকৃতিক পানিচক্র প্রক্রিয়া বিপর্যস্ত করার পাশাপাশি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পানির অপচয়, অপব্যবহার ও দূষণের ক্ষেত্রও ব্যাপক বিস্তৃত। এর ভেতর কৃষি ও শিল্প খাতে অপচয় ও দূষণের মাত্রা ভয়াবহভাবে বেশি। ব্যবহার্য পানির ভাণ্ডার ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে আমাদের চোখের সামনেই। আমাদের অবিমৃশ্যকারিতা নিঃশেষ করে আনছে জীবন দায়িনী পানিসম্পদকে। এই পরিস্থিতিতে সময় এসেছে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করার। অন্যথায় পানির অমিতব্যয়িতা ও দূষণের ফলে মানবজাতির জন্য ধীরে অথচ সুনিশ্চিতভাবে ডেকে আনবে মহাবিপর্যয়।
লেখাঃ আজিজুর রহমান